কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন
মোঃ সায়েদুল ইসলাম
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থাটি ১৯৭৯ সাল থেকে তাদের এই প্রতিষ্ঠা দিবসকে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ হিসেবে উদযাপন শুরু করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’। চলমান বৈশ্বিক মহামারি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান পণ্য মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতাসহ একাধিক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সাথে এ বছর বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২২ পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Leave no one behind. Better production,better nutrition,a better environment and a better life.’ যার ভাবানুবাদ ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষক অন্তপ্রাণ। সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ পুনর্গঠন করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশের সার্বিক উন্নয়নে কৃষির উন্নতির কোনো বিকল্প নেই। তিনি স্বপ্ন দেখতেন কৃষি বিপ্লবের, তাই তিনি সূচনা করেন সবুজ বিপ্লবের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি পূরণে কৃষিবিজ্ঞান, গবেষণা, সম্প্রসারণ, শিল্প ও বাজার উন্নয়নে বিশেষ জোর দেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি পেশায় আকৃষ্ট করতে কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা প্রদান করেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের কৃষির আধুনিকায়নের সূত্রপাত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই।
জাতির পিতার দর্শনকে অন্তরে ধারণ করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিবান্ধব নীতি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছেন। কৃষির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বীজ, সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সহনশীল মূল্যে ক্রয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ বিস্তৃত করার পাশাপাশি কৃষকদের ঋণ সুবিধা প্রদান, নগদ আর্থিক ও উপকরণ সহযোগিতা প্রদান, ফসলের সময়োপযোগী উপযুক্ত জাত ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষির অব্যাহত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বর্তমান বিশে^ পাট রপ্তানিতে প্রথম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান উৎপাদনে একটানা চার বছর তৃতীয় অবস্থান, একইভাবে সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনেও তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে।
কোভিড-১৯সহ বর্তমান বৈশি^ক পরিস্থিতিতেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব ও কার্যকর পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের এক ইঞ্চি কৃষি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সে লক্ষ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপির নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ইউনিয়ন পর্যায়ে সবজি বাগান সৃজনসহ সমলয় চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। গবেষণা খাতে সরকারের অব্যাহত প্রণোদনা ও উৎসাহে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাত, জিংকসমৃদ্ধ ধান, দেশের আবহাওয়া উপযোগী বিভিন্ন ফলের জাতসহ ফসলের জাত উদ্ভাবন করছেন। নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলো জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে সাফল্য এসেছে এবং আমদানি নির্ভরতা অনেক কমে এসেছে। দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে তিন বছরমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ধানের উৎপাদন না কমিয়েই আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে স্থানীয়ভাবে চাহিদার শতকরা ৪০ ভাগ তেল উৎপাদন করা হবে। ২০৫০ সালে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে ‘ডাবলিং রাইস প্রোডাক্টিভিটি-ডিআরপি’ মডেল গ্রহণ করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন রকম উদ্যান ফসল উৎপাদনে পাহাড়ি কৃষির এক বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উচ্চমূল্যের ফসল কাজুবাদাম ও কফি চাষ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের কার্যকর পদক্ষেপে শুধু খাদ্য উৎপাদনই বাড়ছে না, দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এক সময় পাটই ছিল মূলত রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য। বর্তমানে পাট ছাড়াও ৭০টিরও বেশি সবজি ও ফল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আমরা ছাড়িয়ে গেছি ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক। বাংলাদেশের সুস্বাদু আম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববাজারে স্থান করে নিয়েছে। নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনসহ রপ্তানি বাড়াতে ‘বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০ ’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ৭৫ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনযাত্রার জন্য কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে এরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও বিশ্বে চাহিদার বিপরীতে খাদ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত তথাপি বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে পারছে না, যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টির উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। কোভিড-১৯ মহামারি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য, ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ সমভাবে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। যদিও আমরা একটি উন্নত বিশ্ব গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের মুখে অনেক দেশ পিছিয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জনসংখ্যা আরো বেশি আন্তঃসংযুক্ত হয়ে উঠেছে। কোন একটি দেশ পিছিয়ে থাকলে বৈশ্বিক উন্নয়নের শিকলটি ভেঙে যায়। বৈশ্বিক সংকটের মুখে, বৈশ্বিক সমাধান আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন। ভালো উৎপাদন, উত্তম পুষ্টি, একটি সুরক্ষিত পরিবেশ এবং একটি উন্নত জীবনের লক্ষ্য নিয়ে, আমরা দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৃহত্তর স্থিতিস্থাপকতা বিবেচনা করে একটি টেকসই ও সামগ্রিক সমাধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি খাদ্য ব্যবস্থাকে রূপান্তরিত করতে এবং আরও ভালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। সে জন্য সবার নিজ নিজ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ করে যেতে হবে।
জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রূপায়িত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ রূপকল্প ২০৪১ অনুুযায়ী বাংলাদেশকে সুখীসমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পুষ্টি সমৃদ্ধ উন্নত দেশের অভিযাত্রায় সবার কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।
লেখক : সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়।www.moa.gov.bd